টেলিমেডিসিন
ডা: কামাল আহমেদ
গাইনি ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ এবং টেলিমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার
নিশপিং হাসপাতাল, সুইডেন
করোনা ক্রান্তিকাল আমাদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছে। আমাদের জীবনকে অনেক বদলে দিয়েছে এই করোনা ভাইরাস বা কোভিদ-১৯। অনেক শব্দ আমরা নতুন করে শিখেছি এবং শিখছি। যেমন পিপিই, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসটেন্স, লকডাউন ইত্যাদি। যদিও এসব শব্দ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে। করোনা পরিস্থিতি এসব শব্দকে আমাদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় ও অত্যাবশ্যকীয় করে তুলেছে। যেমন পি,পি,ই বা পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট যা জনস্বার্থে নিয়োজিত কর্মীরা ব্যবহার করে। এই পি,পি,ই আজ সাধারণ জনগণ ও ব্যবহার করছে। যাদের এসব পিপিই ব্যবহার করার কথা, তারা ও সবাই এ সম্পর্কে খুব একটা বেশি জানত না। আজ বাংলাদেশের প্রায় সব জনগণই এ বিষয়ে অবগত। এরকম আরেকটি শব্দ হচ্ছে টেলিমেডিসিন, যা আজ শুধু জনপ্রিয় নয় বরং অত্যাবশ্যকীয় ও।
এই টেলিমেডিসিন কী?
এটা দুটা গ্রিক শব্দ ‘টেলি’এবং ‘মেডিসিন’ থেকে এসেছে। টেলি শব্দের অর্থ দূরত্ব আর মেডিসিন শব্দের অর্থ চিকিৎসা। তাহলে টেলিমেডিসিনের সহজ বাংলা দাঁড়ায় দুর থেকে চিকিৎসা।
টেলিমেডিসিনের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসা দেওয়া হয় সেটাই হচ্ছে টেলিমেডিসিন।
টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট যোগাযোগ প্রযুক্তি। এইসব টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে শব্দ, ছবি, ভিডিও, লেখা এবং বিভিন্ন বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় সংকেত আদান প্রদান করা হয়।
টেলিমেডিসিনের সর্বপ্রথম ব্যবহার
সংজ্ঞা মতে টেলিমেডিসিনের সর্বপ্রথম ব্যবহার শুরু হয় টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের আমল থেকে। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল একবার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তার নতুন আবিষ্কৃত টেলিফোনের মাধ্যমে তার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। আর ওটাই ছিল ইতিহাসে টেলিমেডিসিনের সর্বপ্রথম ব্যবহার।
পেশাগতভাবে টেলিমেডিসিনের ব্যবহার সর্বপ্রথম শুরু করে নাসা বা আমেরিকার রকেট বিজ্ঞানীরা। টেলিমেডিসিন তখন ছিল অনেকটা রকেট সায়েন্সই। এই টেলিমেডিসিনের মাধ্যমেই পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে রকেটের কিংবা স্যাটেলাইটের ভিতরের নভোচারীদের শরীরের তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন পর্যবেক্ষণ করা হতো।
তারপর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে টেলিমেডিসিনেরও ব্যবহার বাড়তে থাকে। উন্নত বিশ্বে টেলিমেডিসিনের ব্যবহার প্রচুর। এখন পর্যন্ত টেলিমেডিসিনের সফল ব্যবহার হচ্ছে রোগ নির্ণয় ও রোগীদেরকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে। তবে এই করোনা পরিস্থিতির কারণে এই টেলিমেডিসিন প্রযুক্তি রোগীর সরাসরি চিকিৎসার জন্যও প্রচুর ব্যবহার হচ্ছে।
টেলিমেডিসিন এর সুবিধা কি
টেলিমেডিসিন এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, রোগীকে শারীরিকভাবে ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়া লাগে না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের এক রোগী তার বাড়িতে বসেই সরাসরি ঢাকা কিংবা বিদেশে যেমন ইউরোপ-আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে পারেন।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে রোগীদেরকে দুইবার যেতে হয়। প্রথমবার ডাক্তার রোগীকে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু টেস্ট করতে দেন এবং দ্বিতীয়বার টেস্টের রিপোর্ট দেখে রোগীকে ব্যবস্থাপত্র বা চিকিৎসা দেন। এই দ্বিতীয়বারের ক্ষেত্রে রোগীকে ডাক্তারের কাছে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রোজনীয়। সেক্ষেত্রে ডাক্তারকে রিপোর্টের ছবিগুলো পাঠালেই চলে এবং ডাক্তার শুধু রিপোর্টের ছবিগুলো দেখেই ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন। বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে রোগীকে শারীরিকভাবে ডাক্তারের সামনে উপস্থিত ও হতে হয় না। একটা ছবি বা প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য দিলেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। যেমন চর্মরোগের ক্ষেত্রে শুধু ওই রোগের ছবিটি তুলে ডাক্তারকে পাঠালেই ডাক্তার রোগীর সাথে সরাসরি দেখা না করেও চিকিৎসা দিতে পারেন।
গাইনি ও প্রসূতি রোগের ক্ষেত্রে আমরা উন্নত বিশ্বে নিজেরাই রোগীর আলট্রাসনোগ্রাম করি। কিন্তু বাংলাদেশের গাইনি ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা সাধারণত কোন আল্ট্রাসনোগ্রাম করেন না। যেহেতু বাংলাদেশের গাইনি ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা আলট্রাসনোগ্রাম করেন না, সে ক্ষেত্রে যেসব গাইনি রোগের জন্য মাসিকের রাস্তায় গাইনিকোলজিকাল পরীক্ষা করা লাগে না সেসব রোগী কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করে রিপোর্টগুলো টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পাঠালেই রোগী না দেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। বিশেষ করে প্রসূতি মায়েদের যাদের অন্য কোন সমস্যা নাই তাদের তো একেবারেই দরকার নেই ডাক্তারের সামনে উপস্থিত হওয়ার। উন্নত বিশ্বে বেশিরভাগ প্রসূতি মায়েরা প্রেগনেন্ট হওয়া থেকে শুরু করে হসপিটালে বাচ্চা প্রসব করে বাসায় ও চলে যান এবং কখনো কোন ডাক্তারের দেখা ও পান না।
প্রেগনেন্সি শরীরের একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। প্রেগনেন্সি কোন রোগ না যে এর জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে যেসব প্রেগনেন্ট রোগীদের অন্য রোগ যেমন হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকে, তাদেরকে অবশ্যই একজন প্রসূতিবিদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
আমি এই করোনা ক্রান্তিকালে ফেসবুকে টেলি গাইনি নামক একটি পেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের মা-বোনদের চিকিৎসা দিয়ে আসছি। কোন সমস্যা হচ্ছে না। তারা নিকটবর্তী ফার্মেসি তে গিয়ে ব্লাড প্রেশার মেপে এসে আমাকে জানাচ্ছেন। কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাকে রিপোর্টের ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমি তাদেরকে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছি এবং তারা উপকৃত ও হচ্ছে।
প্রযুক্তিকে কখনো আটকে রাখা যায়না এর বিকাশ ঘটবে যেমনটি ঘটছে মোবাইল ফোন ফেইসবুক ইউটিউব তেমনি টেলিমেডিসিন সেরকম একটি প্রযুক্তি আমরা চাই আর না চাই পছন্দ করি আর না করি আগামী দিনের চিকিৎসার মাধ্যম হবে টেলিমেডিসিন ই।
তবে একটা কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে টেলিমেডিসিন কখনোই ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষার বিকল্প হতে পারে না। টেলিমেডিসিন হচ্ছে চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য আদান প্রদান করার একটি মাধ্যম।
Copyright © All Rights Reserved